সোমবার, মার্চ ১৭, ২০২৫
অনুসন্ধানী রিপোর্ট

আরএন স্পিনিং এবং ফার ক্যামিকেলের একীভূত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত

একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির একীভূতকরণ সাধারণত শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি করে। এতে লাভবান হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু আরএন স্পিনিং এবং ফার কেমিক্যালসের একীভূতকরণ বিনিয়োগকারীদের জন্য লোকসান বাড়াচ্ছে। উভয় কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন আতঙ্কিত।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব শেয়ারের জন্য সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস কার্যকর। আরএন স্পিনিং এবং ফার কেমিক্যালের ফ্লোরের দামও কার্যকর ছিল। কিন্তু কোম্পানি দুটি তালিকাবিহীন কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হওয়ায় নতুন ফ্লোরের মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে একীভূতকরণ আদেশ কার্যকর হওয়ার দুদিন পর উভয় কোম্পানির শেয়ার দর ১০ শতাংশ কমেছে। আগামীতে দুই কোম্পানির শেয়ারের দাম এভাবে কমতে থাকলে প্রকৃতপক্ষে দুই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের অর্থ উধাও হয়ে যাবে।

কিছু বিনিয়োগকারী বলেছেন যে দুটি কোম্পানি তাদের পরিশোধিত মূলধন হ্রাস পেয়েছে যখন থেকে দুটি কোম্পানির সাথে একীভূত হয়েছে। এর ফলে একটি কোম্পানিতে প্রতি তিনটি শেয়ার একটি হয়ে যায়। অপর একটি কোম্পানির শেয়ার প্রতি ৫.৫৯ টাকায় পরিণত হয়েছে।

শেয়ার পতনের পর উভয় কোম্পানির দর সমন্বয় হয়েছে। একটি কোম্পানির কর্পোরেট ঘোষণার পরে, বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু করা হয়, শেয়ারের সংখ্যা বাড়লে, সেই অনুযায়ী নতুন ফ্লোর প্রাইস কমানো হয়। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় না করায় দুই দিনে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন; ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

বিনিয়োগকারীরা রাগান্বিত, তারা হতাশ, কিন্তু কার কাছে যেতে হবে তা তারা জানে না। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত ফেসবুক পেজে তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

নতুন ফ্লোর প্রাইস না থাকায় রেকর্ড ডেটের পর টানা দুই দিন দাম কমেছে। একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের লোকসান ইতিমধ্যেই প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে, অন্যদিকে অন্য কোম্পানির লোকসান ১১ শতাংশের বেশি।

এখন পর্যন্ত, আরএন স্পিনিং এবং ফার কেমিক্যালস ফ্লোরের সীমাবদ্ধতার কারণে, দাম কমতে পারেনি, তবে একীভূত হওয়ার পরে, শেয়ারের দাম তার ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসার সুযোগ রয়েছে।

ক্ষতি কত?

টেক্সটাইল খাতের কোম্পানি আরএন স্পিনিং মিলস তালিকাবিহীন সামিন ফুডসের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। সামিন ফুডসের সকল সম্পদ ও দায় আরএন স্পিনিং মিলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই দুটি কোম্পানির সমস্ত বিদ্যমান ইক্যুইটি শেয়ার বাতিল করা হয়েছে।

আরএন স্পিনিং মিলসকে কোম্পানির ২৩ কোটি ৩১ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮৪ শেয়ারের বিপরীতে সামিন ফুডের শেয়ারহোল্ডারদের নিজস্ব সমসংখ্যক শেয়ার ইস্যু করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

সে অনুযায়ী আরএন স্পিনিং সামিন ফুডের এক শেয়ারের বিপরীতে একটি নতুন শেয়ার ইস্যু করেছে। কিন্তু নিজেদের একটা শেয়ার হয়ে গেছে ০.১৭৯। অর্থাৎ প্রতি ৫.৫৯ শেয়ার একটি শেয়ার হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, তালিকাবিহীন এসএফ টেক্সটাইল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং রাসায়নিক খাতে ফার কেমিক্যালসের সাথে একীভূত হয়েছে। এক্ষেত্রে ফার কেমিক্যালের প্রতি তিন শেয়ারে এক শেয়ার হয়ে গেল।

সোমবার রেকর্ড ডেটের আগের দিন রোববার আরএন স্পিনিং মিলসের প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬ টাকা ২০ পয়সায়। রেকর্ড ডেটের পর মঙ্গলবার শেয়ারটির দর স্থির হয় ২৩ টাকা ২০ পয়সায়। কিন্তু রোববার ৫ দশমিক ৫৯ শেয়ারের দর ছিল ৩৪ টাকা ৬৫ পয়সা। অর্থাৎ একীভূতকরণের কারণে প্রথম দিনেই বিনিয়োগকারীর লোকসান হয়েছে ১১ টাকা ৪৫ পয়সা।

শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় দিনের লেনদেনে দাম ৯.৯১ শতাংশ কমে ২৩ টাকা ২০ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৯০ পয়সা হয়েছে। অন্য কথায়, আরএন স্পিনিংয়ের বিনিয়োগকারীরা দুই দিনে দামের ৩৯ টাকা ৬৮ শতাংশ হারিয়েছে।

ফার কেমিক্যালস থেকে ক্ষতি তার চেয়ে কম। গত কয়েক মাস ধরে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১০ টাকা ৬০ পয়সার নিচে নামতে পারেনি। মঙ্গলবারের একীভূতকরণ প্রতি তিনটি শেয়ারকে একটিতে পরিণত করেছে। সে অনুযায়ী হার সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল ৩১ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু দিন শেষে দর স্থির হয় ৩১ টাকা ৩০ পয়সায়।

ফ্লোরের দামে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় বুধবার আসল ক্ষতি হয়েছে। শেয়ারটির দাম প্রায় ১০ শতাংশ কমে ২৮ টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। আগের মতোই প্রতিটি শেয়ারের দাম ৯ টাকা ৪০ পয়সা। অর্থাৎ দুই দিনে এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ হারান।

ডিএসইর ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ বিস্ময় ডিবিএর

বাংলাদেশ স্টক ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন ডিবিএ সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও আরএন স্পিনিং অ্যান্ড ফার কেমিক্যালসের বিনিয়োগকারীদের এই আর্থিক ক্ষতিকে ‘বিস্ময়কর’ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “এখানে যা ঘটেছে তা অস্বাভাবিক। এই দুই কোম্পানির ট্রেন্ড এভাবে শুরু করা উচিত হয়নি। আমাদের পক্ষ থেকে, আমরা মৌখিকভাবে ডিএসইকে জানিয়েছি যে ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত দুটি কোম্পানির লেনদেন স্থগিত করা উচিত। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি। এখন লোকসানের সাগরে নিপতিত বিনিয়োগকারীরা। শুধু তাই নয়, লোকসান আরও বাড়তে পারে।”

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক আল আমিনের প্রতিক্রিয়া রোজারিওর মতোই।

তিনি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “কিসের ভিত্তিতে এই ঘটনা ঘটল তা স্পষ্ট নয়। একীভূত হওয়ার পর লেনদেনের প্রথম দিনেই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ বা ঘোষণা থাকা উচিত ছিল। ব্যবসায়ীদেরও নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল।

আমি বলছি, কিন্তু কিছু হয়নি, আর মনে হবে না। দিন উত্তর সাধারণ বিনিয়োগকারী মালিকই হয়। কারণ এখানে কোনো ব্যক্তিদিহিতা নেই।

তিনি বলেন, “বোনাস শেয়ার নিয়ে কত কিছু। আপনার পরের বিএসইসি বোনাসের প্রস্তাব নাক করেছে। আবার কোনো কোম্পানির নগদ ও বোনাস শেয়ারের রেকর্ড ডেট একটি ছিল, কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি চালু হয়। কোনো কোম্পানির বোনের শেয়ারের প্রস্তাব দুই মাসেই, কোনোটার আবার তা হতে হতে ১০ বা ১১ মাস হয়।

পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক বলেন, “আপনারা বলেন পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সমস্যা। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে কেন হবে না?

দাম আর কত কমতে পারবে?

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর প্রকাশ ও জনসংযোগ উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কোম্পানির দর আবার তার ফ্লোর প্রাইসে আসতে আসতে।

অন্য আরএন স্পিনিং মিলসের শেয়ার দর আবার ৬ টাকা ২০ পয়সায় আর ফার কেমিকেলসের দর ১০ টাকা ৬০ পয়সায় নামা সম্ভব।

যেহেতু হাতের শেয়ার কমে গেছে, তাই ক্ষতি করে যদি ফ্লোর প্রাইস দেওয়া না হয় তাহলে বিনিয়োগকারীকে সমর্থন করতে হবে, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি একজন ব্যক্তিকে দিতে পারি না। আমাদের ঊর্ধ্বতন ক্ষমতা বলতে সুবিধা।

‘নীতিমালা নেই, কীভাবে ফ্লোর সমন্বয়’

ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ও চিফ অপারেটিং ভোট এম. সাইফুর রহমান মজুমদার ভিডিও সংবাদ মাধ্যমের কাছে অনুরোধ করেন, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসি ফ্লোর প্রাইএস তার আলোকে আলোচনার মাধ্যমেমালা করেছে।

বোনাস ও রাইট শেয়ার সক্রিয় সেই অনুপ্রেরণায় ফ্লোর প্রাইস করা হলে কেন নতুন ফ্লোর বিনিয়োগকারীকে ব্যবস্থা দেওয়া হয়নি- এখানে এই প্রশ্নটি তিনি বলেন, “ফ্লোর প্রাইসের নির্দেশনা আছে, হল গুজব কোম্পানির লভের অংশের অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার দিকে। কিন্তু মার্জার বা অন্য কোনো কারণে কোনো নির্দেশনা বিএসইসির নেই। যদি কর্তার নির্দেশনা থাকে, তাহলে আমাদের কী করার আছে।

তিনি বলেন, “এই যে মার্জার হয়েছে, সংবাদও আমাদের সংবাদ বিরল। আমাদের পুঁজিবাজারে তো নয়ই। কোম্পানি মার্জার হলে কোনো তৃতীয় কোম্পানি হয় কিন্তু এখানে তার কিছু হয়নি।

তিনি বলেন, “এখানে অনেক জটিল ব্যাপার আছে। বিশেষ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তা প্রদান করেছে। তা আদালতও পালন করেছে। আমাদের কাছে। এখন আদালতের নির্দেশের কিছু করতে কিছু করতে হলে আদালতের আদেশ আদেশ। আমাদের তো তা নেই।

বিনিয়োগকারীদের লোকের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বলা হলে তিনি বলেন, “আপনার কথা আমি সাঁতার করছি। কিন্তু আমার তো মার্জার ফ্লোর প্রাইসের কারণে নির্দেশনা দিতে হবে। মনে তো নেই। তাহলে আমি কোন হিসাবে কাজ করব?

এই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইন্‌সির মালিক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “এই যেভাবে হয়েছে, আইন মেনে নিতে হবে না হলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *