বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫
অনুসন্ধানী রিপোর্ট

তহবিল আছে ৬৯০ কোটি টাকা, বিমার দাবি পরিশোধ করতে হবে ৭৭০ কোটি টাকা

সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলামের বীমার মেয়াদ পাঁচ বছর আগে শেষ হয়েছে। টাকার অঙ্ক মাত্র ২৩ হাজার ৭৯৩ টাকা। সেই টাকাও দিতে পারেনি প্রাইম ইসলামী লাইফ। সাইফুল ইসলামের মতো সারা দেশে কোম্পানির হাজার হাজার গ্রাহক বীমার মেয়াদ শেষে বকেয়া আদায় করতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এসব গ্রাহকরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর কাছে সব সময় অভিযোগ করছেন এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মামলাও করছেন। কোন সমাধান নেই। এমতাবস্থায় গ্রাহকদের এই হয়রানি পুরো বীমা খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াচ্ছে। মূলত আর্থিক সংকটের কারণে বীমা কোম্পানিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

২০২০ সালের সর্বশেষ অ্যাচুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশন অনুযায়ী, প্রাইম ইসলামী লাইফের গ্রাহকের দায় ছিল ১৩৮৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এ সময় কোম্পানিটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯২৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ৪৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

অন্যদিকে, কোম্পানির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগের অসম্পূর্ণ বীমা দাবি ছাড়াও ২০২৩ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি এবং পরবর্তী ৫ বছরে ৭৫৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। যার মধ্যে ২০২৩ সালে ১০১ কোটি টাকা দিতে হবে।

আর ২০২৩ সালের জুন মাসের শেষ হিসাব অনুযায়ী (অনিরীক্ষিত) গ্রাহককে এই অর্থ পরিশোধের জন্য কোম্পানির লাইফ ফান্ড ৬৯০ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিনিয়োগ রয়েছে ৬৭১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ বিনিয়োগ থেকে বছরে সম্ভাব্য আয় ৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।

প্রাইম ইসলামী লাইফের প্রিমিয়াম আয়, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ আয় কমছে। ফলে নতুন তহবিল যোগ না করে প্রতি বছরই লাইফ ফান্ড কমছে। অন্যদিকে ক্রমাগত বাড়ছে গ্রাহকের ঋণ। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানির আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দেড় বছরে লাইফ ফান্ড কমেছে ১১৭ কোটি টাকা

কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে লাইফ ফান্ড কমেছে ৩০০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৬ মাসে কমেছে ৮৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত দেড় বছরে লাইফ ফান্ড কমেছে ১১৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

পর্যালোচনায় দেখা যায় যে ২০২১ সালে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল ৪২৯ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং বিনিয়োগ আয় ছিল ৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট আয় ৪৩৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় ১৫৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে ২৯৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হয়েছে ৪৪৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

অর্থাৎ আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে ঘাটতি হয় ১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। একইভাবে ২০২২ সালে কোম্পানিটির তহবিল ঘাটতি ১৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

দেড় বছরে সম্পদ কমেছে ১০৯ কোটি টাকা

প্রাইম ইসলামী লাইফের সম্পদ প্রতি বছরই কমছে। ২০২১ সালে কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯৫৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯০৮ কোটি ৮১ লাখ। এক বছরের ব্যবধানে সম্পদ কমেছে ৪৮ কোটি টাকা।

আর সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুন মাসে মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৪৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের ৬ মাসে সম্পদ কমেছে ৬১ কোটি ২২ লাখ টাকা।

প্রাইম ইসলামী লাইফের এই আর্থিক সংকটের প্রধান কারণ হল কোম্পানির তহবিলের অপব্যবহার, অতিরিক্ত ব্যয় এবং খারাপ বিনিয়োগ।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে ৩৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে

প্রাইম ইসলামী লাইফের ফিক্সড ডিপোজিট কোম্পানির পরিচালকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক রেখে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। বীমা কোম্পানির এমন অনিয়ম ও লুটপাটের তথ্য উঠে এসেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বিশেষ অডিট প্রতিবেদনে।

আত্মসাৎ করা অর্থের মধ্যে রয়েছে – পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা ১৬৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা; স্টার্লিং গ্রুপে ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ; পিএফআই সিকিউরিটিজে BO অ্যাকাউন্টের ১৫ কোটি ৩৭ লাখ; পিআইএসএল-কে ৭৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ঋণ এবং বাংলালায়ন জিরো কুপন বন্ডে প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ।

এ ছাড়া মিরপুরের গোগান চটবাড়িতে প্রাইম ইসলামী লাইফের নামে ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার টাকায় কেনা জমির উন্নয়ন মূল্য সমন্বয় করে ৫৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

১৮৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের জন্য আদালতে ৩টি মামলা

নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রাইম ইসলামী লাইফ গত কয়েক বছর ধরে আর্থিক সংকটে রয়েছে। এই আর্থিক সংকটের মূল কারণ গ্রাহকের আমানতের অপব্যবহার। এতে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ জড়িত।

এই আত্মসাৎকৃত টাকা উদ্ধারে কোম্পানির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ৩টি মামলা করা হয়েছে। কোম্পানি সংক্রান্ত মামলা হাইকোর্ট বিভাগে চলছে।

এ তিনটি মামলায় আত্মসাতের অর্থের পরিমাণ ১৮৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে বাংলালায়ন জিরো কুপন বন্ডে প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ, পিএফআই সিকিউরিটিজে ১৬৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং স্টার্লিং গ্রুপে ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ।

এক জমিতে লোকসান হয়েছে ৯৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা

প্রাইম ইসলামী লাইফের তথ্য অনুসারে রাজধানীর বাংলামোটরে কোম্পানিটির নামে ৩৬.১২ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ও উন্নয়ন খরচসহ এই জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১৯৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। তবে সর্বশেষ ভ্যাল্যুয়েশন প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে এই জমির বাজারমূল্য ১০২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

অর্থাৎ বাংলামোটরের জমিটি ক্রয়ে প্রাইম ইসলামী লাইফের লোকসান হয়েছে ৯৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, যা ক্রয়মূল্যের ৪৮ শতাংশ।

এ ছাড়াও রাজধানীর মিরপুরে ৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় কেনা ১৪৪.৫৯ শতাংশ জমি, সিলেটে ৫ কোটি ৭ লাখ টাকার ১৬.৬৬ শতাংশ জমি এবং রাজশাহীতে ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকার ৩৬.৫৯ শতাংশ জমি রয়েছে প্রাইম ইসলামী লাইফের।

তবে এসব জমির বাজারদর মূল্যায়ন করা হয়নি। এরমধ্যে রাজশাহীতে কেনা ৪.৭৯ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার।

বিধি লঙ্ঘন করে বিনিয়োগ

তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে জুন শেষে প্রাইম ইসলামী লাইফের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৬৭১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে ১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ২.৯২ শতাংশ।

অথচ লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ প্রবিধানমালায় সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে সম্পদের অন্যূন ৩০ শতাংশ।

এক্ষেত্রে সম্পদ বলতে বোঝানো হয়েছে, বীমাকারীর দায়সমূহের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করার লক্ষ্যে বিনিয়োগকৃত এবং বিনিয়োগযোগ্য অর্থ।

২০২৩ সালের জুন হিসাব অনুসারে প্রাইম ইসলামী লাইফের পলিসিহোল্ডার লায়াবিলিটি রয়েছে ১৩২৫ কোটি ২ লাখ টাকা। এই হিসেবে সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ থাকার কথা ৩৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

অপরদিকে কোম্পানিটি স্থাবর সম্পত্তি খাতে বিনিয়োগ করেছে ২৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা মোট বিনিয়োগের ৪১.২৮ শতাংশ। অথচ এ খাতে বিনিয়োগের অনুমোদিত সীমা লাইফ বীমাকারীর সম্পদের ২০ শতাংশ।

ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় ৭১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা

প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সাত বছরে মোট ৭১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালিত অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এই গবেষণাটি ২০১৮ সালে জীবন বীমা কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়ে পরিচালিত হয়েছিল। দুদক পরে আইডিআরএকে অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য ১৬টি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।

যদিও পরবর্তীতে অর্থাৎ ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রাইম ইসলামী লাইফ আর খরচ করেনি। কোম্পানির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ের মধ্যে ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনুমোদিত সীমার নিচে।

তবে প্রাইম ইসলামী লাইফ নির্দেশ দিলেও আগের অতিরিক্ত খরচ পরিশোধ করতে পারেনি।

বীমা কোম্পানির বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামছুল আলম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডিকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগে থেকেই কোম্পানিতে এমন আর্থিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণের চেষ্টা চলছে।

ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। আদালতে কয়েকটি মামলার শুনানিও চলছে। তবে মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোম্পানির নিয়োগকৃত আইনজীবী ভালো বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।

বীমা দাবি পরিশোধ প্রসঙ্গে সামছুল আলম বলেন, ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও অনেক কমে গেছে। একই সঙ্গে বাংলামোটরে কোম্পানির কেনা জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের বকেয়া বীমা দাবি পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পত্রিকায় জমি বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *